ডানকির্ক থেকে একাত্তর: স্টার্ডি কিংবা মতিউর রহমানদের গল্প !



ক্রিস্টোফার নোলান সম্ভবত এর চেয়ে অসাধারণ রিভিউ কিংবা প্রশংসা আর আশা করতে পারতেন না। ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের ডানকির্ক বন্দর থেকে ৩,৩০,০০০ মিত্রবাহিনীর সেনাসদস্যদের উদ্ধার করার ইতিহাস নিয়ে তৈরি তার ডানকির্ক চলচ্চিত্রটি ইতিমধ্যেই দোর্দন্ড প্রতাপে এগিয়ে চলছে, সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে অবিরাম উচ্ছ্বাস আর অভিনন্দনের জোয়ার। কিন্তু এবার কানাডার ক্যালগ্যারিতে ডানকির্কের প্রিমিয়ার দেখে বেরিয়ে সেই ব্যাটেলফিল্ড থেকে ফেরা ব্রিটিশ যোদ্ধা কেন স্টার্ডি যা বললেন, তারপর আর কারোর প্রশংসা না পেলেও চলবে নোলানের!

“আমি কখনও ভাবিনি, এগুলো আমি আবার দেখবো। এটা দেখে মনে হচ্ছিল, আমি আবার সেই দিনগুলোতে ফিরে গেছি।”

মন্তব্য: আর সেই ভয়ংকর ব্যাটেলফিল্ডে, যেখানে মাত্র নয় দিনে হাজার হাজার সৈন্য মারা গেছে, সেখান থেকে বেঁচে ফেরা অল্প কয়েকজনের মধ্যে একজন স্টার্ডি যখন মুভির প্রিমিয়ার শো শেষে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ডানকির্ক’ নিছক বিনোদন নয়; এটি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেইসব ভয়াল দিনে, যখন নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে হাজার হাজার সৈন্যকে বাঁচাতে নিরন্তর লড়াই করছিলেন তারা, তখন আসলেই আর এই মুভির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না।

প্রিমিয়ার থেকে বেরিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন স্টার্ডি। ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে আগুয়ান হিটালারের নাৎসি বাহিনী মিত্রবাহিনীকে পিছু হটাতে হটাতে ডানকির্ক বন্দরে আটকে ফেলেছিল, পেছনে ইংলিশ চ্যানেলের অকুল পাথার, সামনে বিভীষিকার মতো ধেয়ে আসছে জার্মানরা, এমন এক অকল্পনীয় সংকটের সময় হঠাৎই জার্মান বাহিনীকে হল্টের নির্দেশ দেন হিটলার। অপ্রত্যাশিত এই সুযোগে মিত্রবাহিনীর চার লাখেরও বেশি সেনাকে উদ্ধার করে আনার একটা সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু ইভাকুয়েশনের জন্য ব্রিটিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে বড় বড় যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে নারাজ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, তার ভাষায় বলতে গেলে তিনি এই চার লাখ সেনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যুদ্ধজাহাজগুলো পাঠিয়ে শক্তিক্ষয়ের চেয়ে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বেশি আগ্রহী! যুদ্ধের এই কঠিন সময়ে নিজ দেশের এমন নির্দয় রূপের সময় দাঁড়িয়ে যখন দিশেহারা মিত্রবাহিনী, জার্মান সেনাবাহিনীর হঠাৎ হঠাৎ এয়াররেইডের মুখে মারা যাচ্ছে শত শত ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ সৈন্য, তখনই হঠাৎ এক অবিশ্বাস্য এবং অকল্পনীয় বিস্ময়ে হাজির হয় সাহায্য, ওদের বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। এমনই অসাধারণ এক ইতিহাসকে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পারস্পেক্টিভ থেকে পর্দায় খুব সহজ এবং সরল আত্মবিশ্বাসে উপস্থাপন করেছেন নোলান, যা দর্শককে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আসন থেকে উঠতে তো দেবেই না, বরং মুভি শেষ হবার পরেও অনেকক্ষণ স্তব্ধ করিয়ে রাখবে এই ভাবাতে ভাবাতে যে, কী দেখলাম এটা!

আর সেই ভয়ংকর ব্যাটেলফিল্ডে, যেখানে মাত্র নয় দিনে হাজার হাজার সৈন্য মারা গেছে, সেখান থেকে বেঁচে ফেরা অল্প কয়েকজনের মধ্যে একজন স্টার্ডি যখন মুভির প্রিমিয়ার শো শেষে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ডানকির্ক’ নিছক বিনোদন নয়; এটি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেইসব ভয়াল দিনে, যখন নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে হাজার হাজার সৈন্যকে বাঁচাতে নিরন্তর লড়াই করছিলেন তারা, তখন আসলেই আর এই মুভির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না।

ছবি:সাবেক সৈনিক স্টার্ডি
ওই সময়ের কথা মনে করে স্টার্ডি বলেন, “আমি ছিলাম, ওই ছোট ছোট নৌকাগুলোর একটিতে, যেগুলোতে করে আটকে পড়া সৈন্যদের উদ্ধার করা হচ্ছিল। আজ আমি ওই দিনগুলোকে সিনেমায় দেখার সুযোগ পেলাম। কিন্তু সেসময় ওই সমুদ্রসৈকতটিতে কী ঘটেছিল মনে পড়ায় মন বিষাদে ভরে গেছে।” ৩৩০০০০ সেনাকে বাঁচিয়ে আনা গিয়েছিল ডানকির্ক থেকে, কিন্তু প্রায় ১০০০০০ এরও বেশী ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ সেনা মারা গিয়েছিল সে যুদ্ধে। মুভিটা দেখতে গিয়ে বারবার হারানো সেসব সহযোদ্ধাদের কথা মনে পড়েছে জানিয়ে স্টার্ডি বলেন, সেসময় আমার বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। কিন্তু মুভিটা দেখতে বসে এত দিন পর আমি যেন আমার হারানো সহযোদ্ধাদের আবার নতুন করে খুঁজে পেয়েছিলাম, যারা ওই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিল। চোখের সামনে মরতে দেখা আমার বন্ধুদের সেই ভয়ার্ত চেহারাগুলো আবার যেন দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি আমার অনেক বন্ধুকে ঐ যুদ্ধে হারিয়েছি।” শুধু ৯৭ বছর বয়েসী স্টার্ডিই নন, ৯৬ বছর বয়েসী আরেক ডানকির্ক ভেটেরান ব্রিটিশ সেনা জর্জ ওয়েগনার বাষ্পারুদ্ধ কন্ঠে বলেন, পুরো মুভিটা যেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই সময়ে, পুরো স্ক্রিনপ্লেটা অসাধারণ এবং খুবই বাস্তবধর্মী। তরুণ প্রজন্মের প্রতি সিনেমাটি দেখার আহ্বান জানিয়ে স্টার্ডি বলেন,“স্রেফ বিনোদনের জন্য ‘ডানকির্ক’ দেখতে যাবে না। এটি দেখে ভাবো। এবং যখন বড় হবে, তখনও এটি নিয়ে ভাববে। আজ রাতে আমি কেঁদেছি, কারণ, যুদ্ধের শেষ নেই। কখনো শেষ হবে না। আমরা মানব প্রজাতি কত আশ্চর্য অর্জন করেছি। আমরা চাঁদে গিয়েছি, কিন্তু এসব নির্বুদ্ধিতা থামাতে পারিনি।”

মুভিতে অভিনয় করা বিখ্যাত আইরিশ অভিনেতা কেনেথ ব্রাওনা তার এক অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে গিয়ে বলেন, নব্বই বছরের উপর বয়সী ৩০ জন ডানকির্ক ভেটেরানের সাথে তিনি ডানকির্কের প্রিমিয়ার দেখেছেন এবং তাদের প্রত্যেকেই ডানকির্ককে অসাধারণ থ্রিলিং এবং চোখে সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো বলে উল্লেখ করেছেন। তারা এটাও বলেছেন, মুভিটা মেকিং-এর মুন্সিয়ানায় ক্ষেত্রবিশেষে আসল ঘটনার চেয়ে একটু বেশিই শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে পড়েছিল। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ছিল যে, আকাশ থেকে একটার পর একটা বোমা ফেলা হচ্ছে, সেই শব্দ এবং নোলানের যুদ্ধটাকে ফুটিয়ে তোলার বিস্ময়কর দক্ষতার কারণে রুদ্ধশ্বাস সময়টা এমনভাবে দখল করে নিচ্ছিল তাকে যে দৃশ্যধারণের অনেকক্ষণ পরেও তিনি ডানকির্কের সেই ভীতিজাগানিয়া যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলেন না!

ডানকির্ক দেখি। নোলানের অকল্পনীয় সৃষ্টি দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। মুভি শেষ হওয়ার পরেও চোখ সরাতে পারি না। চোখ সরাতে পারলেও মাথার ভেতর থেকে দৃশ্যগুলো সরে না। সেই যে ব্রিটিশ বিমানটা, সংশপ্তকের মত যে লড়াই করে গেল ফুয়েলের শেষবিন্দুটুকু থাকা পর্যন্ত, কি অবলীলায় লিখলো আত্মত্যাগের ইতিহাস! হঠাৎ করেই কেন যেন আমার মতিউরের কথা মনে পড়ে। সেও চেয়েছিল ঠিক এইভাবে স্থলে লড়াই করতে থাকা সহযোদ্ধাদের কাভার দিতে, সেই পাকিস্তান থেকে, পাকিস্তানীদের নাকের ডগা থেকে উড়িয়ে এনেছিল টি-৩৩! কি অসমসাহসী! কি অকুতভয়! মনে পড়ে শত সহস্র মুক্তিযোদ্ধার কথা। শত্রুপক্ষের চোয়াল থেকে সহযোদ্ধা বাঁচিয়ে ফেরাবার অসংখ্য ইতিহাস, সহযোদ্ধাদের পিছিয়ে যাবার সুযোগ করে দিতে ভীম গর্জনে শেষ রক্তবিন্দু, শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাওয়া অযুতনিযুত ইতিহাস! একজন নোলানের অবিশ্বাস্য দক্ষতায় আজ ডানকির্কের বীরদের সামনে তাদের জীবন সায়াহ্নে যুদ্ধদিনের সেই স্মৃতিগুলো বাস্তব হয়ে উঠছে, তারা যেন ফিরে যাচ্ছেন সেই সময়টায়, আবার আরেকবার হারানো সহযোদ্ধা, ভাই-বন্ধু-স্বজনের স্মৃতি মনে করে তাদের জন্য দুফোঁটা চোখের আপনি ফেলতে পারছেন। কিন্তু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কি হবে?

তাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে মুভি বানানো তো দূরে থাক, তাদের অপারেশনগুলোর ঘটনার বেশিরভাগ জানি না আমরা। বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিশাল অংশকে আজ পর্যন্ত চিনিই না। চেনার ইচ্ছাও নেই, মুভি বানানো তো বহু পরের কথা। ডানকির্কের বাজেট ছিল ১০ কোটি ডলার, আমাদের দেশের কারেন্সীতে ৮০০ কোটি টাকা। আজ পর্যন্ত এই ৪৭ বছরে আমাদের কয়টা মুক্তিযুদ্ধের মুভির বাজেট এক কোটি টাকা ছিল, সেটা গবেষণা করে বের করতে হবে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অপারেশনগুলো নিয়ে একজন গুণী পরিচালকের পরিচালনায় বড় বাজেটের সত্যিকারের একটা ফুল স্কেল ওয়ার মুভি বানাতে পারি না আমরা? এমন একটা মুভি, যেটা স্টার্ডির মতো আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেইদিনগুলোতে, তারা স্মৃতিকাতর হবেন, হয়তো চোখটা ভিজে যাবে একাত্তরের সেই অদ্ভুত ভয়ংকর সময়ে হারিয়ে ফেলা সহযোদ্ধা, ভাই-বন্ধুদের কথা মনে পড়ায়!

যারা আমাদের স্বাধীনতা কিনে আনলেন বুকের তাজা রক্তের দামে, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথাগুলো সংগ্রহ করা, সেগুলো অসাধারণ কিছু চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া কি আমাদের কর্তব্য না? খুব বেশী চাওয়া কি এটি?

Note: লেখাটি ঈষৎ মার্জিত ও সংগৃহীত



R-Rad

লেখক পরিচিতি

রহমান রাদ
রহমান রাদ একজন জনপ্রিয় লেখক। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখনীতে তার বিশেষ কৃতিত্ব আছে। তিনি অনেক সময় ধরে ইন্টারনেট এ নতুন প্রজন্মকে তার বিশেষ লেখনীর মাধ্যমে উৎসাহিত করে আসছেন।






Published on: 26/07/2017